————————————–
বাল্য বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদ্বেগজনক চিত্র কারোই খুব বেশি অজানা নয়। জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএ-র সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বাল্য বিয়ের ক্ষেত্রে এখন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেই শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।
বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩-এ ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে বয়স ১৮ হওয়ার আগেই বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ১৫ বছর বা তার কম বয়সী মেয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিয়ের হার ২৭ শতাংশ।
বাংলাদেশে ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি ক্রিশ্চিন ব্লুখস এই অনুষ্ঠান বলেন, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি, যা বয়ঃসন্ধিকালে গর্ভধারণের উচ্চ হারের কারণ। ১৫ থেকে ১৯ বছর বছর বয়সী প্রতি ১০০০ জনে ৭৪ জন সন্তান জন্ম দিচ্ছে। প্রতি চারজন বিবাহিত কিশোরীর মধ্যে প্রায় একজন ইতিমধ্যেই সন্তান ধারণ করা শুরু করেছে।
বাংলাদেশে বাল্য বিয়ের উচ্চ হারের ক্ষেত্রে সমাজ বিজ্ঞানীরা যেসব কারণ নির্দেশ করেছেন, তার অন্যতম বড় কারণ দারিদ্র্য। এখনো অনেক পরিবারে মেয়েদের ‘বোঝা’ মনে করা হয়। নিরাপত্তার অভাব আরও একটি বড় কারণ। রাস্তা-ঘাটে মেয়েদের একটা বড় অংশ যৌন হয়রানি বা ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়। এসবের আইনি প্রতিকার মেলে সামান্যই। অনেক পরিবারেরই মূল অভিভাবক থাকেন প্রবাসে। প্রবাসীদের পরিবারে নিরাপত্তার অভাব আরও তীব্র। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব ও বাংলাদেশে বাল্য বিয়ের হার অপরিবর্তিত থাকার একটি কারণ বলে সমাজ বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করেন। জলবায়ুজনিত কারণে অনেককেই বাসস্থান পরিবর্তন করতে হচ্ছে। বাসস্থান পরিবর্তনের আগে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া ভালো মনে করছে কোনো কোনো পরিবার।
বাল্য বিয়ের কুফল সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকার সচেতনতামূলক অনেক পদক্ষেপ নিলেও এসবের সুফল মিলছে সামান্য। ২০১৭ সালে সরকার বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাশ করে। তাতে বেশ কিছু ধারায় কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়। এই আইনটি ব্রিটিশ সরকার প্রণীত ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট-১৯২৯’-কে প্রতিস্থাপন করে। আগের আইনেও বলা হয়েছিল কোনো নারী ১৮ বছরের আগে এবং কোনো পুরুষ ২১ বছরের আগে যদি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ তবে এই শাস্তির সময়কাল এবং অর্থদণ্ড বর্তমান সময়ের সাপেক্ষে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম ছিল৷ ফলে এই আইনটি তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। বর্তমান আইনে বয়সের সীমা একই রেখে, শাস্তির সময় এবং অর্থদণ্ডের পরিমাণ বাড়ানো হয়। পাশাপাশি, নতুন আইনে শাস্তির আওতায় কারা আসবে, তাও ঠিক করে দেওয়া হয়।
কিন্তু আইনটির একটি বিশেষ ধারায় বাল্য বিয়েকে বৈধতা দেওয়া হয়। এই ধারায় বলা হয়, বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং পিতা-মাতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে, বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।
বাল্য বিয়ের প্রতিরোধে কাজ করছেন এমন ব্যক্তিরা বলেছেন আইনের এই বিশেষ ধারার অপপ্রয়োগ হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই, যা বাল্য বিয়ে প্রতিরোধের অনেক উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম এই আইন প্রণয়নের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি বলেন, এই আইন সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক সমালোচনা আমাদের কানেও এসেছে। কিন্তু এটিকে যদি যথাযথ প্রয়োগ করা যায়, তাহলে বাল্য বিয়ে বন্ধ হবেই।
আইন প্রয়োগের পাশাপাশি আরও কিছু উদ্যোগেরও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। যেমন, শতভাগ অনলাইন জন্ম নিবন্ধন ও ব্যক্তির একক শনাক্তকরণ নাম্বার।
সরকারের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, তাদের নানাবিধ উদ্যোগের ফলে বাল্য বিয়ের হার এখন যথেষ্ট নিম্নগামী।
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভীন বলেন, আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, সেখানে কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বাল্যবিবাহের হার কমেছে। আমি মনে করি এটা ঠিক লাইনেই আছে। যদি নতুন কোনো সার্ভে হয়, বাল্য বিয়ের হার ১৫ থেকে ২০ পার্সেন্ট হতে পারে। কিন্তু এর বেশি হবে না আমার মতে।
২০১৮ সালের এক কর্মপরিকল্পনায় বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাল্য বিয়ে কমিয়ে আনার একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল। তাতে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বা তার কমবয়সী মেয়েদের বিয়ের কথা শূন্যের মধ্যে এবং ১৮ বা তার কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার কথা বলা হয়। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্য বিয়ে সম্পূর্ণ বন্ধ করার কথাও বলা হয়েছিল। জাতিসংঘের সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল-এর আওতায়ও ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্য বিয়ে নির্মূলের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কিন্তু করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এক্ষেত্রে কোনো বাড়তি উদ্যম দেখতে পাচ্ছেন না। কোভিড মহামারি চলার সময়ে বাল্য বিয়ে মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম অনেকটাই গতি হারায়। এই সময়টা নতুন করে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। সব মিলিয়ে এই সময়ে স্কুল বন্ধ থাকে ৫৪৩ দিন। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চললেও ইন্টারনেটের উচ্চ ব্যয় এবং দুর্বল গতি আর উপযুক্ত গ্যাজেটের অনুপস্থিতির কারণে গ্রামীণ এলাকার ছাত্ররা অনেকাংশেই পিছিয়ে পড়ে। প্রতিকূল সেই সময়ে অনেক পরিবার তাদের আয় হারিয়ে ফেলে এবং তাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
অনেকদিন ধরেই বাল্য বিয়ে বন্ধে বেসরকারি উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের পরিচালক ডক্টর মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন, করোনার কারণে সরকার তার ফোকাস অন্যদিকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে, যা বাল্য বিয়ের সাম্প্রতিক চিত্রে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলেছে।
‘খুব সম্প্রতি আমার যে বোধ বা আমার যা মনে হচ্ছে, কোভিড পরবর্তী সময়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে…করোনার সময়ে অনেকে অর্থনৈতিকভাবে খারাপ অবস্থায় পড়েছিল, যে কারণে সরকারকে বিভিন্ন প্রায়োরিটি ঠিক করতে হয়েছে, তাছাড়া সরকার বিভিন্ন ধরনের মেগা প্রকল্প নিয়েছে, সেগুলোতে অর্থায়ন চলমান রাখতে হয়েছে। তো সেটি করতে গিয়ে আমার মনে হয়, বাল্য বিয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সরকার প্রায়োরিটির দিক থেকে সেরকমভাবে নজর দেয়নি। যে কারণে সরকারের অন্যান্য জায়গায়, যেমন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট বা মেগা প্রকল্পগুলোতে যতটা মনোযোগ আছে, এই বাল্যবিবাহ নিরোধের ক্ষেত্রে ততটা মনোযোগ বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে না’-বলছেন ড. রফিকুল ইসলাম।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন আজাদ মজুমদার। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।
Leave a Reply