অনলাইন : লাখ পেরিয়ে সম্পাদক ! শিকল বাঁধার সাধ্য কার !

  • আপডেট সময় বুধবার, জুলাই ২৮, ২০২১
  • 549 পাঠক

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী বললেন, আইপি টিভির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু কতগুলোর বিরুদ্ধেইবা এ ব্যবস্থা নেবেন তিনি! সবগুলো কি তাঁর জানা আছে। রয়েছে ফেসবুক টিভি, অনলাইন টিভি। আছে ছোট বড় অনলাইন পোর্টাল। সব মিলিয়ে লাখ পেরিয়েছে অনেক আগেই। আবার প্রতিটিরই রয়েছে সম্পাদক ও প্রকাশক। অনলাইন মানে এক্ষুনি লাইন নয়। কিন্তু অবাধ যান্ত্রিকতার বলয়ে মাত্র ৯০০ টাকা দিয়েই মেলে এক্ষুনি লাইন। হয়ে যাবেন সম্পাদক, প্রকাশক। চাহিবা মাত্রই বাহক পদবী পেতে বাধ্য। এভাবে দেশ-বিদেশে লাখ ছাড়িয়ে সম্পাদক, প্রকাশক। পরিতাপের বিষয় যে, এখানে যেন আইনের শাসনের কোন বালাই নেই। অথচ, সাংবিধানিক বাক স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করতে গেলেই নেমে আসে অন্ধকারে শিকল লাগার শব্দ। হামলা-মামলা । ডিজিটাল নিরাপত্তার কান্না। কিন্তু, সরাসরি ডিজিটালকে জীবনের ঝুকিতে ঘেরাও করলেও এখানে যেন ডিজিটালেরই হাত, পা, মুখ সবই বাঁধা।

 

——————-

আকাশ মো. জসিম

———————

গত ক’দিন আগে এক সুহৃদের জানাজায় অংশ নিয়েছিলাম। জানাজা শেষে এক বন্ধু জানতে চাইলেন, পাশের করম আলী পুরো জানাজা ভিডিও করেছে, আপনি করছেননা কেন! বললাম, তার যে যোগ্যতা আছে তা হয়তো আমার নেই বলেই পারছিনা। কথাটুকু শেষ হতে না হতেই করম আলী এসে পাশে দাঁড়ালেন।

বন্ধু তাকে বললেন, সাম্বাদিক সাব (সাহেব) এই সম্পাদককে চেনেননা!  করম আলী বললেন, চিনি। উনি এক লাইনে আছে। আমি আরেক লাইনে। উনি পত্রিকায়। আমি সরাসরি লাইভসহ টিভি চ্যানেলে। এটি নাকি তার অনলাইভ টিভি। একইসাথে একটি বেপরোয়া অনলাইন পোর্টালও নাকি আছে তার। করম আলী নিজ থেকে বললেন, কথিত টিভির মালিক, সম্পাদক ও ফটোগ্রাফার সবই তিনি। বললেন, অনেক ব্যস্ত থাকি।

যেমনটি হয়েছে অনেক সরকারী প্রাথমিকের শিক্ষকের জীবনধারায়। একাধারে নামখাওয়াস্ত শিক্ষক, আবার এলাকার বিয়ের কাজি, পাশাপাশি পল্লী চিকিৎসক।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। করম চলে গেলে ওই বন্ধুকে বললাম, আমি করমদের সম্পর্কে সবই জানি। আপনি তার সাথে আমাকে পরিচিতি করতে চাওয়াটাও ঠিক হয়নি। বন্ধু বললেন, এরা টিকটক করে আর কি ! এক সময় ধরা খেয়ে যাবে। লেখাপড়ায় সর্বোচ্চ নিম্ম মাধ্যমিক। বললাম সব বুঝেও কেন এদের বিষয়ে খোঁজ খবর জানতে চান!

বন্ধুকে বললাম, আপনি তো আমার ছাত্রজীবন জানেন। আজ থেকে ২২ বছর আগে স্মাতক শ্রেণী পাশ করে সাংবাদিকতার খাতায় নাম লিখিয়েছি। কিছু পেয়ে না পেয়েও দিনের পর দিন টিকে থাকার চেষ্টায় অক্লান্ত হচ্ছি। এখনো নিজেকে সাংবাদিক, সম্পাদক বা প্রকাশক বলার অধিকার রাখিনা। এদের সাথে আমাদের পার্থক্য এ জায়গায়ই। বন্ধু বললেন, শুধু এ একাই নয়। আমি আরো এ রকম এক ডজনেরও বেশি লোককে চিনি। যারা টিকটক মার্কা সাম্বাদিক (সাংবাদিক)।

এর কিছুদিন আগে ঢাকার হঠাৎ এক কথিত দৈনিকের পরিচয়দানকারী কোন এক ব্যক্তিগত সুবিধার স্বার্থে নোয়াখালীর একটি জনপ্রিয় দৈনিকের  এক শুভাকাঙ্খীকে ধমকের স্বরে বললেন, আরে আমি অমুক দৈনিকের সাংবাদিক ( তার ভাষায় সাম্বাদিক)। এটি আবার পত্রিকা হলো নাকি!  অথচ, ওই যুবকের গলায় ফাঁসির ফিতার সাথে লাগানো নগদের কেনায় কার্ড ছাড়া ওই নামের পত্রিকাটি নোয়াখালী দুরে থা্ক, ঢাকার ওয়ালেও কোনদিন কেউ দেখেননি।

ডিজিটাল বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণহীনতার কবলে চরিত্র, শ্রেণী, পেশাদারিত্ব ও মর্যাদা হারিয়ে চলছে এ দেশের জনসভ্যতায় সমাজ জীবনের অলংকৃত গণমাধ্যমজগত।

দেশে গণমাধ্যমের অনলাইন সংস্কৃতি শুরুর পর রাষ্ট্র বা সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলমহলের সঠিক নজরদারি কিংবা অনুমোদন ছাড়াই লাখও ছাড়িয়ে গেছে খামাখো অনলাইন প্রকাশক ও সম্পাদকের সংখ্যা।

খবরটি পুরো দায়িত্বশীল সমাজ ব্যবস্থার জন্যে একটি অশনিসংকেত হলেও, তাতেও যেন কারো কিছুই যায় আসেনা। বরং, কোন কোন মহল এরুপ অসংলগ্নতাকে আরো বেশি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাণিত করছেন।

অথচ এটি একটি উন্নত রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলেও পরিগণিত। যা সমাজ পেরিয়ে পুরো বৈশ্বিক জীবন সভ্যতার একটি পরিমেয় দর্পণ। একইসাথে, এটি একটি সমাজ ব্যবস্থার লালন, পালন ও সুস্থ্য সভ্যতায় পরিচালনের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামোও।

একটি গণমাধ্যমের অস্তিত্বের সাথে শিক্ষার মৌলিক অর্জনও জরুরী। আর তা না হলে যে নিদ্রিত বুদ্ধির সজীবতাই বিকাশের প্রধান অন্তরায়। এক সময় দেশের গণমাধ্যম জগতে নিজেদের দায়িত্বশীল করছেন দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবিমহল।

হালে শুধুমাত্র সাংবাদিকতা বিষয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে নিজেদের দায়িত্বশীল করলেও এক সময় তারাও প্রায় এ পেশা থেকে ছিটকে চলছেন।

অধিকিন্ত, একটি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নিজেকে সম্মানরক্ষার জায়গা থেকে কোনভাবেই বিসর্জিত করতে পারেননা। করেননা। ফলে শূণ্যস্থানের পূরণস্থানে অন্য বিষয়ে উচ্চতর সনদধারীরাই এ পেশায় বেশি জুটছেন। অধিকিন্তু তারা এ পেশায় নিজেদের চৌকষভাবেও ধন্য করছেন।

এসবের জাঁতাকলে আরেকটি শ্রেণী মাত্র মাধ্যমিক বা তারও নিচের যোগ্যতা নিয়ে এ পেশায় বেশ দাপট খাটাচ্ছেন। এটি শুধু মফস্বল নই, পুরো জাতীয় পর্যায়েও কমবেশি রয়েছে। যাদের শিক্ষাগত দৈন্যতা প্রকট। যা একটি সাংবাদিকতা পেশার জন্যে মোটেই সুখকর নই।

তবুও সার্বিক সমাজে লোকলজ্জা উপেক্ষা করে তারা অনেকটা বেপরোয়া, বেহায়া ও বেরোখাবেশকেই যোগ্যতার মানে উন্নীত করে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয়ে শানিত, অনুপ্রাণিত ও উচ্ছ্বাসিত করছেন। এটি শুধু মফস্বল নই, পুরো জাতীয় পর্যায়েও কমবেশি রয়েছে।

গণমাধ্যমের জায়গা ছেড়ে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে যোগদান করা একজন জানালেন, সাংবাদিকতায় অনার্সসহ স্মাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। তিনি যে পত্রিকায় কাজ করেছেন, সেখানে মাত্র মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকও অনেকে রয়েছে। যাদের ভারের চেয়ে ধার বেশি। যে কারণে তিনি নিজেকে তাদের সাথে পাল্লা রেখে এ পেশায় সম্পৃক্ত রাখার অনিহা নিয়ে ছেড়ে এসেছেন।

নোয়াখালী কোর্টে মাত্র ক’বছর আগের একজন মোহরা ( আইনজীবি সহকারী ) তিনিও এখন একটি জাতীয় গণমাধ্যমের অনেক বড় সম্মানের দাপুটে লোক। আরেকটি উপজেলায় সাইকেল চুরির জন্যে নির্মমতার শিকার হওয়া এক যুবকও জাতীয় পর্যায়ে কাজ করে এ পেশায় অনেক পদক নিয়েছেন।

অবশ্য , এসবে তাদের পেশাদারিত্ব চেষ্টা, শ্রম আর অন্য সহায়ত্বে নিজেকে অসহায় করার কসরতও কম ছিলনা।

উপজেলা থেকে মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক নিয়ে বেশ কয়েকজন জাতীয় পর্যায়ে বেশ দাপুটে হয়ে গেছেন। আবার, তাদের মধ্যেও যারা কমপক্ষে স্মাতক নিয়ে এ পেশায় জড়িয়েছেন তারা মাধ্যমিক বা নামখাওয়াস্তদের চেয়ে দৌড়ে কিছুটা স্তম্ভিত থাকলেও নিজেরাই স্বীয় আত্মসম্মান সুসংহত করেই পেশাদারিত্ব করছেন।

তবে আরেকটি উৎকণ্ঠার বিষয় যে, অনলাইনের পাশাপাশি মূদ্রণ জগতেও কম ধাপ্পাবাজ নেই।

ঢাকার এমন অনেক পত্রিকা রয়েছে যাদের সম্পাদনা, প্রকাশনা নিয়ে রয়েছে নানা মুখরোচক সত্যরচনা। যারা পত্রিকা প্রকাশ ও প্রচার করতেই কাজে লাগান যত্রযত্র প্রতিনিধি নিয়োগের বাহনা।

আবার, প্রতিটি প্রতিনিধির পরিচয়পত্রসহ নামে বেনামে এবং পত্রিকা পাঠানোর নামেও কামিয়ে নেন মাসিক ধান্ধা। এসব কথিত সম্পাদকরা প্রতিনিধিদের পাঠানো বিজ্ঞাপণেরও পুরো অংকই গিলে খাওয়ার ঘটনাও মিথ্যে নয়।

কিন্ত হালে দেশে-দেশে, ঘরে ঘরে যেভাবে অনলাইন সম্পাদক আর প্রকাশকের আর্বিভাব ঘটছে, তা অবশ্যই একটি সংবিধিবব্ধ রাষ্ট্র বা সরকারের জন্যে আর্শীবাদের বিপরীতে অভিশাপেরই শামিল।

আবার এসব অনেক অনলাইনের কথিত সম্পাদকদের নিয়োগ প্রদান করা অনেক সংবাদকর্মীরও শিক্ষাদীক্ষা চরম নৈরাজ্যকর, অনভিপ্রেত ও হতাশাজনক। বলা চলে যেখানে সম্পাদকই শিক্ষামানে বিকারগ্রস্ত সেখানে সাংবাদিকেরই বা যোগ্যতার কি দরকার!

কতেক অনলাইন প্রচারণায় এমনও সম্পাদক, প্রকাশক রয়েছে যাদের নিজস্ব কোন ল্যাপটপ বা কম্পিউটারও নেই। নেই এ সম্পর্কিত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা দীক্ষার সভ্যতা।

আবার মাত্র এক হাজার টাকা, কোথাও তারও কমে ডোমেইন কিনে তারা বনে গেছেন সম্পাদক, প্রকাশক। যাদের নেই প্রকাশনার নিজস্ব ঠিকানাও।কিন্তু, একটি সমাজে তারাও হয়ে গেছেন র্দুদান্ত সাংবাদিক, সম্পাদক কিংবা কথিত গণমাধ্যমের মালিক বা প্রকাশকও।

অন্যদিকে, আরেকটি উদ্বেগের বিষয় যে তারা দেশে দেশে শত শত হতাশাগ্রস্তকে কার্ড বিলিয়ে রাতারাতিই বানিয়ে দিচ্ছেন প্রবল গণমাধ্যমকর্মী।

সেদিন আরেকজন রাতারাতি কার্ডধারী বললেন, পরিষ্কার সত্য কথা। চরম অভাব-অনটনে পড়েই এ লাইনে এসেছেন। বললেন, সরকারী দপ্তরে গিয়ে কার্যালয়ের কর্তাকে বলেন, হয়তো বিজ্ঞাপণ দেন। নয়তো আপনার পজেটিভ নিউজ করতে চাই । এ বাবত খরচপাতিও চেয়ে নেন তিনি। জানালেন, ক’দিন ভালই কামিয়েছেন। এখন শরীর একটু খারাপ যাচ্ছে। তাই আপাতত একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন।

সারাদেশে এভাবে অসংখ্য অনলাইন নামীয় সংবাদ মাধ্যমের কারণে মূল ধারার সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা কিংবা অনুমোদিত অনলাইনগুলোও জনসমাজে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়ে পারেনা। আবার এসব প্রকাশক, সম্পাদকের অনেকেরই পেরেকে মাত্র নাম লিখতে পারা, কিংবা কপি পেষ্ট কিংবা ভাবসাবও দুরন্ত যোগ্যতা।

ফলে আগামীর সংবাদ মাধ্যম একটি বিকৃত সভ্যমহলের (!) ধাক্কা সামলে কতটুকু স্বকীয়তায় গৌরান্বিত থাকবে এটি নি:সন্দেহে প্রশ্নযোগ্য।

তবে  একালের এসব  সাংবাদিকতা যদি নির্মল সেন, মাহফুজ আনাম কিংবা মতিউর রহমান চৌধুরীদের দেখানো পথে না হোক ; অন্তত রোজিনাদের পথেও হাঁটতে শেখাতো তাহলে  হয়তোবা আমরাও গৌরবান্বিত হওয়ার একটা সুযোগ রচতো।

কিন্তু যে সাংবাদিকতা দলবাজি, চামচামি, তোষামোদি, তেলবাজির পথ দেখায় তা একটি উন্নত পেশার স্বকীয়তা আর মর্যাদা রক্ষায় কোনভাবেই সহায়ক নই। বরং , তা দেশ ও জাতির একটি নির্ভয়া স্বপ্ন হেনস্থা করারই পথ চেনায়।

এ যুগের সমাজব্যবস্থায় ধাণ্ধাবাজি, দলবাজি আর চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্যের বাসনায় যে সাংবাদিকতার পথ সৃষ্ট হয়ে চলছে তা কোনভাবেই দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাংবাদিকতাকে সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় সিক্ত করেনা।

এ কালের কালিমালিপ্ত সাংবাদিকতার মুর্চ্ছনায় কথায় কথায় সাংবাদিকদের ওপর চলে হামলা। মামলা। নির্যাতন। অথচ পেশাদারিত্বের চির উন্নত মম শির মননের সমন্বয়ের সাংবাদিকতায় আবারো ফিরে দাঁড়ালে কোন অন্তরায়ই প্রকৃত পেশাদারিত্বে শিকল বাঁধার সাহস রাখেনা।

 

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!