আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কেন নেই আত্ম-অনুশোচনা ?

  • আপডেট সময় বুধবার, ২০ আগস্ট, ২০২৫
  • ৫৯ পাঠক

মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার
২০ আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের সময় সরকারি বাহিনী ও সরকারি দলের হামলায় বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে ; অনেকে গুরুতর আহত হন। এরপরও কেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কারও মধ্যে তেমন কোনো অনুশোচনা নেই—এটা বেশ অনেক দিন ধরেই রাজনৈতিক আলোচনায় সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত প্রশ্নগুলোর একটি। তাদের অবস্থান পরিবর্তন না করাতে পারার ক্ষেত্রে অন্যদের ভূমিকা কী, এমন প্রশ্নও এখন সামনে আসছে।

বিশ্লেষণ 

————————————————————————————————–

আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কারও মধ্যে তেমন কোনো অনুশোচনা নেই-এটা বেশ অনেক দিন ধরেই রাজনৈতিক আলোচনায় সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত প্রশ্নগুলোর একটি। এই লেখায় সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন

———————————————————————————-

আরও প্রশ্ন ওঠছে, অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থক, যাঁরা অভ্যুত্থানের সময় নিজ দলের বিপক্ষে চলে গিয়েছিলেন, তাঁরা কেন আবার ‘চরম’ অবস্থানে ফিরে গেলেন ?

অনেকেই দাবি করেন, আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শকে ধর্মের মতো দেখেন এবং নেতাকে সব ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে মনে করেন ; তাই তাঁদের মধ্যে আত্ম-অনুশোচনার বোধ তৈরির চেষ্টা করে লাভ নেই। কিন্তু এই যুক্তি দিয়েই কি সব দায় এড়ানো যাবে ? ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, যুদ্ধ, বিপ্লব বা অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে প্রতিপক্ষের মনোভাব বদলাতে কেবল রাজনৈতিক বক্তব্য যথেষ্ট নয় ; দরকার হয় মানুষের বিবেক নাড়া দেয়ার মতো পদক্ষেপ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী মিত্রশক্তি পরাজিত জার্মানির সেনাসদস্য ও সাধারণ নাগরিকদের সামনে নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নির্যাতনের ভয়াবহ ভিডিও চিত্র দেখিয়েছিল। ‘ডেথ মিলস’ বা ‘জার্মান কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ফ্যাকটুয়াল সার্ভে’ নামের এসব ফুটেজ মানুষকে তাদের অতীত কর্মকাণ্ডের মুখোমুখি দাঁড় করায়। ভিডিও চলাকালে অনেককে দেখা গেছে মাথা নিচু করে, চোখে পানি নিয়ে বসে থাকতে।

অনেকেই হয়তো এমনটা বলবেন, জার্মানির এই উদাহরণ দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার ফল, যা বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। এটা হয়তো ঠিক। কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট, প্রতিপক্ষের মানসিকতা বদলাতে হলে শুধু রাজনৈতিক বিজয় যথেষ্ট নয়; দরকার হয় নতুন সাংস্কৃতিক ভিত্তি গড়ে তোলা।

আমাদের ক্ষেত্রে সেটি প্রথম থেকেই হওয়া উচিত ছিল ; গণ-অভ্যুত্থানের ওপর ভিত্তি করে সৃজনশীল উদ্যোগের মাধ্যমে এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলা, যা প্রতিপক্ষকে ধীরে ধীরে মানবিক উপলব্ধির দিকে নিয়ে আসবে। কিন্তু আমরা সেই পথ নিতে পারিনি, বরং শহীদ ও আহতদের প্রত্যাশা ভঙ্গ করে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারার হিসেব-নিকাশেই ব্যস্ত থেকেছি।

—————————————————————————————————————

জুলাই অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের উপর অস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা

—————————————————————————————————————

কেউ কেউ বলতে পারেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে এখনো আওয়ামী লীগ আমলের অনেক নির্মমতা-নৃশংসতার ছবি, ভিডিও, তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। অনেকে সেসব দেখেছেও। তাহলে আবার কেন এসব পদক্ষেপ নিতে হবে ? কিন্তু একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, দেখা মানেই বোঝা নয়।

প্রথমত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ভিডিও একটি বিশেষ মুহূর্তের আর এটা প্রায়ই নিজ নিজ দলের পক্ষে ব্যাখ্যার সঙ্গে মিলে যায়। তাই রাজনৈতিক দলের সমর্থকেরা সাধারণত সেই তথ্যকেই সত্যি ভাবে, যা তাঁর পূর্ববর্তী বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে যায়।

——————————————————————————————————–

দ্বিতীয়ত, ছবি, ভিডিও, তথ্যপ্রমাণ দেখানো আর ‘ গাইডেড রিফ্লেকশন ’ এক বিষয় নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এগুলো কেবল দেখানোই হয়নি, ছিল আলোচনা ও মুখোমুখি প্রশ্নোত্তর। এটা মানুষকে নিজের ভূমিকা ও পূর্বের রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ছবি বা ফুটেজে এ রকম কোনো প্রক্রিয়া নেই, বরং অনেক সময় তা মানুষের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দেয়।

——————————————————————————————————–

তৃতীয়ত, আজকের ডিজিটাল দুনিয়া একধরনের ‘ ইকো চেম্বার ’, যেখানে মানুষ কেবল সেই কনটেন্টই দেখে, অ্যালগরিদম যা তার সামনে আনে। আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা যদি শুধু নিজেদের তৈরি ব্যাখ্যা বা কাটছাঁট করা ভিডিও দেখেন, তবে তাঁরা কখনোই পুরো ঘটনাটা জানতে পারবেন না এবং বিষয়গুলো উপলব্ধি করবেন না। এই চক্র ভাঙতে ‘ গাইডেড কাউন্সেলিং ’ বা ‘ ফ্যাসিলিটেটেড ডায়ালগ ’ দরকার হয়, যেখানে সরাসরি প্রমাণ, মানবিক অভিজ্ঞতা আর ভিন্নমতের মানুষের উপস্থিতি থাকে।

অনেক অভিযুক্তের যখন অপরাধ স্বীকার করার কথা, তখন তা না করে তাঁরা বরং সবকিছুর জন্য ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দায়ী করছেন এবং ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’কে সামনে নিয়ে আসছেন। এ রকম বাস্তবতায় আমাদের কথাবার্তা, কার্যক্রম ও কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। কারণ, দায়িত্বশীল রাজনীতির প্রথম শর্ত আত্মসমালোচনা। এ রকম অবস্থায় সৎ সাহস নিয়ে আমাদের প্রধান কিছু ভুল নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা দরকার।

—————————————————————————————————————

 ৩২ নম্বরে বাড়িটি ভাঙার সিদ্ধান্ত একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ ছিল এবং এটি একটি বড় রাজনৈতিক ভুল—এ বিষয়টা এখন স্পষ্ট।

—————————————————————————————————————

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বাড়ি ভাঙচুর

শেখ মুজিবুর রহমান সত্যিই স্বাধীনতা চেয়েছিলেন নাকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন—এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার কয়েক বছর পর ১৯৭৫ সালে তিনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করেছিলেন ; অন্যদিক শেখ হাসিনা অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি, লুটপাট এবং সর্বোপরি স্বৈরাচারী শাসনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করেছেন, যুক্তিসংগতভাবেই এসব সমালোচনা করা যায়। কিন্তু তারপরও ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এখানেই একসময় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন বিকশিত হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ হয়তো এই বাড়িকে নিজেদের ‘ রাজনৈতিক সম্পত্তি ’ হিসেবে একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু তাই বলে এর ঐতিহাসিক মর্যাদা অস্বীকার করা যায় না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড কিংবা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পরেও কেউ এই বাড়ি ভাঙার মতো হঠকারী কাজ করেনি।

রাজনীতির বিরোধিতা করা এক জিনিস, কিন্তু প্রতিপক্ষের আবেগের প্রতীক ধ্বংস করে দেয়া আরেক বিষয় ; এ রকম কাজ উল্টো তাদের আরও একতাবদ্ধ করে। ৩২ নম্বরে বাড়িটি ভাঙার সিদ্ধান্ত একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ ছিল এবং এটি একটি বড় রাজনৈতিক ভুল—এ বিষয়টা এখন স্পষ্ট।

দায় স্বীকার না করার সংস্কৃতি

২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন বা গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়েছিল মূলত ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এই আন্দোলনকে নিজের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে।

বিরোধী দল জামায়াত ইসলামীকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা হয়েছিল। জামায়াত-শিবিরের সব সদস্য বা সমর্থককে যুদ্ধাপরাধী বা ‘ রাজাকার ’ বলা যে সঠিক নয়, অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থককে তখন সেটা বোঝানো যায়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকেও বিতর্কিত করেছিল আওয়ামী লীগ। এর ফলে বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে।

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি আশ্চর্যজনকভাবে পাল্টে যায়। জামায়াত-শিবিরের অনেকেই এখন খোদ মুক্তিযুদ্ধকেই মুসলমানদের জন্য ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ হিসেবে দাবি করছেন ; এমনকি ‘ আত্মস্বীকৃত পাকিস্তানপন্থী’ জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের পক্ষে শাহবাগে স্লোগান দেয়া হয়েছে।

জামায়াত-শিবিরের নেতারা এখনো ১৯৭১ সালের কর্মকাণ্ডের জন্য সরাসরি তাঁদের দায় স্বীকার করেননি। ‘যদি’, ‘কিন্তু’ শব্দ ব্যবহার করে নানা রকম শর্ত সাপেক্ষে কিংবা নানা রকম অযৌক্তিক উদাহরণ দিয়ে তারাঁ কার্যত বিষয়টা অস্বীকারই করেছেন। একইভাবে আওয়ামী লীগও তাদের আমলে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করছে না।

দুটি দল প্রায় একই রকম কৌশল অবলম্বন করছে। কখনো কখনো নিজেদের অপরাধ ঢাকতে অপর পক্ষের অপরাধকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থক মনে করে ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান হলো ১৯৭১ সালকে আড়াল করার একটি প্রজেক্ট। জামায়াত যেমন ১৯৭১ সাল থেকে শিক্ষা নেয়নি, তেমনি আওয়ামী লীগও ২০২৪ সাল থেকে শিক্ষা নেবে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এভাবে অপরাধের দায় স্বীকারের সংস্কৃতি নষ্ট হয়, নৈতিক জবাবদিহি হারিয়ে যায় এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি আরও বিষাক্ত হয়।

পরিবর্তনের শপথ ভুলে যাওয়া

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, তারা একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে অগ্রসর হবে। তারা অতীতের দুঃশাসন, দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে একটি নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ করবে, এমন প্রত্যাশা ছিল অনেকের। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের পর দেখা গেল, তারা দ্রুত সরকারের অংশ হয়ে গেল। এই ‘আত্মঘাতী’ সিদ্ধান্তের পরিণতি হলো, অল্প কয়েক দিনের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। এটা হয়তো তারা স্বীকার করবে না, কিন্তু এ রকম ইঙ্গিত এখন স্পষ্ট।

——————————————————————————————————–

সরকারের অংশ হওয়ার পর তাদের অনেকের মধ্যে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি এবং উগ্রপন্থীদের কর্মকাণ্ডে পরোক্ষ সমর্থন—এসব প্রবণতা বেড়েছে। রাস্তায় নারীদের হয়রানি বা নিজ দলের ভেতরের নারীনেত্রীদের মৌখিক ও শাররিক নিপীড়নের ঘটনায় তারা নীরব থেকেছে। একই সঙ্গে তারা ‘ফেক নিউজ’ ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়িয়ে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করছে, যা শেখ হাসিনার আমলের তাঁর সমর্থকদের কৌশলের সঙ্গে মিলে যায়।

——————————————————————————————————–

সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, কেউ কেউ গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে ২০২৪ সালকে বারবার ১৯৭১ সালের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না, ১৯৭১ ছিল জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আর ২০২৪ ছিল একটি দমনমূলক সরকারকে সরিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ার চেষ্টা। এই মৌলিক পার্থক্য পরিষ্কারভাবে জনগণকে বোঝাতে না পারা এবং বারবার দুটো বিষয়কে মুখোমুখি দাঁড় করানোর ফলে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগের সমর্থকদের আরও বেশি এককাট্টা করে তুলছে।

ট্যাগিংয়ের রাজনীতি

৫ আগস্টের পর দেখা গেছে, নানা রাজনৈতিক ট্যাগ ও প্রচারণার মাধ্যমে বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপিকে রাজনীতিতে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।

কিছু ইউটিউবার ও ইনফ্লুয়েন্সার বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সালাহউদ্দিন আহমদকে ‘ভারতের দালাল’ তকমা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। অথচ মির্জা ফখরুল ইসলাম একজন অভিজ্ঞ ও গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন নেতা। অন্যদিকে সালাহউদ্দিন আহমদ আওয়ামী লীগ আমলে গুমের শিকার হয়েছিলেন এবং বছরের পর বছর ভারতে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন।

এ ধরনের ট্যাগিং হয়তো নেতারা সামলে নেন বা পাত্তা দেন না ; কিন্তু বিএনপির সাধারণ কর্মী-সমর্থকেরা এগুলো ভালোভাবে নেন না। আগে বিএনপির কর্মীরা গ্রাম থেকে শহর—সব পর্যায়েই আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সঙ্গে রাজনৈতিক তর্কবিতর্কে সক্রিয় ছিলেন।

——————————————————————————————————–

এই বিতর্কগুলো অনেক সময় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে নিয়ে যেত। কিন্তু ‘ভারতের দালাল’ ট্যাগিং একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এগুলোর ধারাবাহিক প্রচারণা বিএনপির কর্মীদের অনেক ক্ষেত্রেই কোণঠাসা করে ফেলে। এই সুযোগে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার আরও বেশি পরিসর পাচ্ছেন।

——————————————————————————————————–

‘ ভারতবিরোধিতা ’ এবং ‘ ভারতীয় আধিপত্যের বিরোধিতা ’—দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। জিয়াউর রহমানকে ভারতবিরোধী বলা যায় না ; তিনি ভারতের কর্তৃত্ববাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন, আবার দেশের স্বার্থ রক্ষায় ভারতের সঙ্গে কাজও করেছেন। আমাদের কৌশল হওয়া উচিত যারা ভারতের হেজিমনি বা আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়ছে, এ রকম শক্তির সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলা।

কিন্তু ইউটিউবার ও সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সারদের ভুল প্রচারণায় বিএনপিকে ‘ ভারতের দালাল ’ হিসেবে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে। এই সরলীকৃত ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা আসলে ভারতীয় কর্তৃত্ববাদী শক্তিকে যেমন সুবিধা দিচ্ছে, তেমনি আওয়ামী লীগকেও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করছে।

শেষ কথা

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতি নতুনভাবে সাজানোর বড় সুযোগ এসেছিল। আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সমর্থকদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশকে ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানে নিয়ে আসতে পারলে রাজনীতিতে একধরনের ভারসাম্য আনা যেত।

কিন্তু ভুল কৌশল, অযথা ট্যাগিং দেয়া, সব দলেরই চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়া—এসব কারণে সেই সুযোগ অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের নীরব অস্বস্তি কাজে লাগানো যায়নি; বরং তাঁরা আগের অবস্থানে আরও শক্তভাবে ফিরে গেছেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থানের পর যেমন অনেক ত্যাগী মানুষ হতাশ হয়েছিলেন, তেমনি এবারও অনেক আন্দোলনকারী এখন হতাশাগ্রস্ত। এই হতাশার জন্য কার, কতটুকু দায় রয়েছে, ভবিষ্যতে আমাদের সেই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।

মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার, শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!