———————————————————————————————————————-
মহিউদ্দিন আহমদ।। লেখক ও গবেষক
০৮ সেপ্টেম্বর , ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।।
বদরুদ্দীন উমর আর নেই। নিউমোনিয়া বাসা বেঁধেছিল বুকে। কয়েক মাস ধরেই হাসপাতাল আর বাসা আসা-যাওয়া ছিল। সেই ধকল তিনি আর সামলে উঠতে পারেননি। নবতিপর মানুষটি এমনিতে ছিলেন প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা টগবগে তরুণ। কথা বলার সময় গলার স্বর কখনো কখনো সপ্তমে উঠত। স্মৃতিশক্তি ছিল ক্ষুরধার। ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে যা লিখেছেন, মুখস্থ আওড়ে যেতে পারতেন। অনর্গল বলে যেতেন। শেষের দিকে শ্রবণশক্তি কমে গিয়েছিল। হিয়ারিং এইড ছিল খুব অপছন্দ। আলাপের সময় বিষয় লিখে দিতে হতো।
বদরুদ্দীন উমরের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭০ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর। তাঁর তিনটি বই সাম্প্রদায়িকতা, সংস্কৃতির সংকট ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা পড়ে আমাদের প্রজন্ম সেক্যুলার ধ্যানধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। আমরা ঋদ্ধ হয়েছি। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে পাকিস্তানবাদের মোড়কে প্রতিক্রিয়াশীলতার যে আফিম আমাদের গেলানো হচ্ছিল, তার নিপুণ একাডেমিক ব্যবচ্ছেদ দেখেছি এই সব বইয়ে। তরুণ বয়সে বইগুলোর সঙ্গে পরিচয় না হলে আমি অনেক কিছুই জানতাম না।
এর পরপরই ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হলো ভাষা আন্দোলন নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইয়ের প্রথম খণ্ড। এ দেশে একাডেমিক ধাঁচের ইতিহাস গবেষণা তাঁর হাত দিয়েই শুরু, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এ ক্ষেত্রে তিনি তো পথিকৃৎ।
আমাদের দেশে অনেকেই লেখেন। অনেকেই রাজনীতি করেন। বদরুদ্দীন উমরের মধ্যে এই দুইয়ের সমন্বয় ঘটেছিল। বলা যায়, রাজনীতি আর লেখালেখি এক মোহনায় মিশে গিয়েছিল তাঁর জীবনে। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সক্রিয় ছিলেন। তিনি একই সঙ্গে রাজনীতির অ্যাকটিভিস্ট ও বুদ্ধিজীবী। এ ধরনের ব্যক্তিকে বলা হয় ‘অরগানিক ইন্টেলেকচুয়াল’। এটা আমাদের দেশে বিরল।
—————————————————————————————————————
বদরুদ্দীন উমর একসময় পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। একই সঙ্গে নিয়মিত লিখেছেন গণশক্তি, হলিডে ও গণকণ্ঠ পত্রিকায়। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ গণকণ্ঠ পত্রিকার সুবাদে। আমি তখন ওই পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা। গণকণ্ঠ পত্রিকায় তাঁর উপসম্পাদকীয় ছাপা হতো প্রতি রোববার। আমি তাঁর শান্তিনগরের বাসা থেকে লেখা নিয়ে আসতাম শুক্রবার। সম্মানীর চেক হাতে করে পৌঁছে দিতাম বাসায়। তারপর দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ ছিল না।
————————————————————————————————————–
শেখ হাসিনা তাঁর ওপর খুবই ক্ষিপ্ত ছিলেন। কারণ, উমর বলতেন, প্রথম পর্যায়ে ১৯৪৮ সালে পাঁচ দিন জেলে থাকা ছাড়া ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ভূমিকা নেই। এ ধরনের কথা হাসিনার পক্ষে হজম করা সম্ভব ছিল না। উমর এতটাই জানতেন যে হাসিনা তাঁকে ঘাঁটাতে সাহস পাননি। সহ্য করে গেছেন। যা উমর কখনো কারও কাছে বলেননি, তাঁর অনেক কিছুই আমাকে বলেছেন। সময় ও সুযোগ পেলে সেসব প্রকাশ করব।
বছর দুই আগে তাঁর সঙ্গে আবার যোগাযোগ হয় এক বন্ধুর মাধ্যমে। আমার বেলা-অবেলা বইটি পড়ে তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তারপর তাঁর রূপনগরের বাসায় গেছি অনেকবার।
গণকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয় আর প্রবন্ধের একটা সংকলন তৈরি করেছিলাম বাতিঘরের জন্য। সেখানে বদরুদ্দীন উমরের ৯টি লেখা ছিল। তাঁর অনুমতি নিতে গিয়েছিলাম। আমার চেহারা দেখেই তিনি রাজি হয়ে যান। আমি তাঁকে ঢাউস সাইজের বেশ কয়েকটি বই দিলাম। তিনি বললেন, ‘আপনি এত লেখেন?’ জবাবে বলেছিলাম, ‘আপনাকে বিট দেব।’
বদরুদ্দীন উমর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার নিরাপদ চাকরি ছেড়ে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) মুখপত্র গণশক্তির সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বেতন-ভাতার ঠিক ছিল না। পার্টির কাজে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
‘শ্রেণিচ্যুত’ হওয়া বলতে যা বোঝায়, তিনি সেটি হয়েছিলেন। গরিব চাষির বাড়িতে থাকা-খাওয়া, রাস্তার ধারে প্রাতঃকৃত্য সারা। বিচিত্র তাঁর সে সময়ের অভিজ্ঞতা। তাঁকে বলেছিলাম, ‘আমি এখন ডি-ক্লাসড, গ্রামে থাকি।’ বাড়ির ছবি দেখালাম। ছবি দেখে তিনি খুবই উচ্ছ্বসিত। বললেন, ‘আমি যাব।’ পরে শরীর-স্বাস্থ্য বিবেচনা করে ক্ষান্ত হন।
বদরুদ্দীন উমরের বয়স হয়েছে। আমি এক বন্ধুর মাধ্যমে অনুরোধ জানালাম, সাক্ষাৎকার নিতে চাই। তিনিও জানালেন, কখন কী হয়, বলা যায় না। কিছু কথা বলে যেতে চান। তো গেলাম তাঁর বাসায়। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু মুহাম্মদ কাইউম। ঝাড়া তিন ঘণ্টা সাক্ষাৎকার নিলাম। কাইউম ভিডিও করলেন। কথা তখনো ফুরায়নি। পরদিন আবার গেলাম। আবারও তিন ঘণ্টা। ছয় ঘণ্টার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি হলো পাণ্ডুলিপি। প্রথমা প্রকাশন এটি ছাপল ২০২৪ সালের আগস্টে। বইয়ের নাম ‘বামপন্থার সুরতহাল: বদরুদ্দীন উমরের ইতিহাস পরিক্রমা’।
সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দীন উমর অনেক খোলামেলা কথা বলেছেন। আমি সবই লিখে দিয়েছি। এ ধরনের সাক্ষাৎকারে অনেক বৈঠকি আলাপ হয়। কেউ কেউ মনে করেন, সব ছাপানো ঠিক নয়। আমি সে রকম ভাবি না। কে কী মনে করলেন, সেটা নিয়ে ভাবতে গেলে অনেক কিছুই লেখা যায় না। পশ্চিমের দেশগুলোয় এ ধরনের রাখঢাক বা শুচিবাই নেই।
আমাদের সমাজে এটা প্রবল-পাছে লোকে কিছু বলে। জীবন তো একটাই। যা মনে আসে, তা বলা দরকার, লেখা দরকার; আমি এমনটাই মনে করি। সমস্যা হলো ‘মব’। দেখা যায়, একটা কিছু লিখলে ভবঘুরে, অর্বাচীন বা মূর্খের দল ঝাঁপিয়ে পড়ে। আবার অন্যদিকে দেখা যায়, ‘ সুশীল’রাও ‘মব’ তৈরি করে বলতে থাকে, এটা বলা উচিত হয়নি, ওটা লেখা ঠিক নয় ইত্যাদি।
বদরুদ্দীন উমর সক্রিয় রাজনীতি করেছেন। তাঁর দল কখনোই পাদপ্রদীপের আলোয় আসেনি। সুতরাং তাঁকে অনেকেই এককথায় নাকচ করে দিতে পারেন। এটা নিয়ে তাঁর কোনো দুর্ভাবনা ছিল বলে শুনিনি। এমন তো হয় অনেক সময় যে মানুষ পঙ্গপালের মতো ছুটছে একদিকে, আর অন্য একজন স্থির দাঁড়িয়ে আছে বা অন্যদিকে হাঁটছে। সংখ্যা দিয়ে সাফল্য বিচার করার মানসিকতা দিয়ে আমরা রায় দিতে বসি, কে ঠিক আর কে বেঠিক।
আমরা এমন একটা দেশে বাস করি যেখানে দ্বিধান্বিত, ভণ্ডামি, ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের ছড়াছড়ি। আমি অনেককে জানি, যাঁদের প্রতি রোমকূপ দিয়ে বিপ্লব ফেটে বেরোচ্ছে। তাঁরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সরকারি কোনো সংস্থায় চাকরি করেন। কিন্তু তাঁদের চাকরি যায় না। বহাল থাকে। কীভাবে সম্ভব? সেদিক দিয়ে বদরুদ্দীন উমর ব্যতিক্রম। নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে কখনো প্রতারণা করেননি।
উমর বাংলা একাডেমি পুরস্কার নেননি। একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিছুদিন আগে একটি প্রতিষ্ঠান তাঁকে আজীবন সম্মাননা দিয়েছিল। তিনি সেটি গ্রহণ করেননি। তাঁর একটা নীতি ছিল, তিনি সরকার বা করপোরেট জগতের কাছ থেকে কিছু নেবেন না। বলতেন, ‘লেখালেখি আমার প্যাশন। মনের আনন্দে লিখি। সে জন্য পুরস্কার নিতে হবে কেন।’
————————————————————————————————————-
বদরুদ্দীন উমর ধূমপায়ী ছিলেন। পাইপ ব্যবহার করতেন। তাঁর প্রিয় তামাক ছিল ‘এরিনমোর’। একবার তাঁকে বলেছিলাম, পরেরবার এলে তাঁর জন্য তামাক নিয়ে আসব। বাজারে খুঁজে পাইনি। তিনি বললেন, ‘না এনে ভালো করেছেন। বন্ধুরা কেউ বিদেশ থেকে এলে গিফট করে যায়। এখনো ছয় মাসের স্টক আছে।’ মিষ্টি পছন্দ করতেন। আর এ বয়সেও পড়াশোনা করতেন প্রচুর।
————————————————————————————————————-
বদরুদ্দীন উমরের অনুযোগ ছিল, অনেক প্রকাশক তাঁকে ঠকিয়েছেন। আমাকে খোলাখুলি বলেছেন, নাম ধরে ধরে। আমার বইয়ে সেসব উল্লেখ করেছি।
শেখ হাসিনা তাঁর ওপর খুবই ক্ষিপ্ত ছিলেন। কারণ, উমর বলতেন, প্রথম পর্যায়ে ১৯৪৮ সালে পাঁচ দিন জেলে থাকা ছাড়া ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ভূমিকা নেই। এ ধরনের কথা হাসিনার পক্ষে হজম করা সম্ভব ছিল না। উমর এতটাই জানতেন যে হাসিনা তাঁকে ঘাঁটাতে সাহস পাননি। সহ্য করে গেছেন। যা উমর কখনো কারও কাছে বলেননি, তাঁর অনেক কিছুই আমাকে বলেছেন। সময় ও সুযোগ পেলে সেসব প্রকাশ করব।
দাপটের সঙ্গে একটা জীবন কাটিয়েছেন বদরুদ্দীন উমর। অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, তিনি অহংকারী। তাঁর তো তেমন ধন-সম্পদ নেই। ব্যাংকার স্ত্রীর চাকরির সুবাদে মীরপুরের রূপনগরে ছোট একটা বাড়ি তৈরি হয়েছিল। মাথার ওপর ছাদ ছিল। আর ছিল জ্ঞানের, পাণ্ডিত্যের অহংকার। এটা থাকতেই পারে।
আমরা কাউকে বড় করে তুলতে তাঁর নামের সঙ্গে অনেক বিশেষণ যুক্ত করি। বদরুদ্দীন উমরের ক্ষেত্রে এটার দরকার হয় না। তিনি লিজেন্ড, সাহসী, বিদ্রোহী, এসব বলে কী হবে। তাঁর বইগুলোই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে। প্রশ্ন হলো, মূর্খের দেশে প্রবন্ধকারের জীবন খুব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তিনি এখন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আমার প্রার্থনা, তাঁর সাহসের কিছুটা হলেও যেন আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। আমি সেটাই আগলে ধরে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব আর স্মরণ করব তাঁকে।
মহিউদ্দিন আহমদ , লেখক ও গবেষক
Leave a Reply