আকাশ মো. জসিম।। ২৭ আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।।
বাড়ির পাশের মাত্র তৃতীয় শ্রেণী হতে ঝরে যাওয়া এক যুবক, হালে গলায় ফিতা লাগিয়ে সমাজের সর্বত্রই পরিচয় দেন, তিনি এখন সাংবাদিক। একাধিক ফিতায় রয়েছে ছাপা পত্রিকা, অনলাইন, ইউটিউবও নামীয় সাংবাদিক পচিয়। এসব দেখে বাবা জানতে চাইলেন, সে মাত্র দ্ধিতীয় শ্রেণী পাশ। সে কিভাবে সাংবাদিক হয় ! তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, তাহলে তুমি স্মাতক পাশ করে কি লাভ হলো ! বাবার এমন প্রশ্নের জবাবে আমি বরং রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থাকেই দোষতে হয়। করেছিও তাই।
প্রবাস জীবনের কিছু বছর শেষে দেশে এসে আরেকজন হাতে বাইসাইকেল চালিয়ে কিছুদিন মোরগের ব্যবসা করছিলেন। এ গ্রাম, সেগ্রাম। এ হাট-ওহাটে। কিছুদিন পর তিনি একটি পত্রিকার বিজ্ঞাপণ প্রতিনিধির পরিচয়পত্র গলায় ঝুলিয়ে হাঁটতেন। ইতোমধ্যে তিনিও একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক।
আরেকজন মুদি দোকানীও এখন ৪টি পত্রিকার কারখানার প্রকাশক পরিচয়ে সম্পাদক। রয়েছে বিভিন্ন জাল-জালিয়াতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামীও। আবার কোন সংবাদমাধ্যমের মাত্র ক্যামেরাম্যান, সেও এখন যে কোন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি হয়ে চলছেন যখন-তখন।
রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ নামের খ্যাত গণমাধ্যম কাঠোমো দিনদিন একটি ভঙ্গুর, নামখাওয়াস্ত, বিপর্যস্ত ও বেহালদশার দিকে ধাবিত হয়ে চলছে। তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়েও। কোথাও যেন এ স্তম্ভের মান, মর্যাদা ও গৌরব রক্ষায় রাষ্ট্র কিংবা কোন সরকারই অঙ্গীকারবদ্ধ নয়।
অথচ রাষ্ট্রের এমন একটি মানহীন কাঠামোর পেছনে সরকার তথা রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা গচ্ছা হয়। রয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়, প্রশিক্ষণেরও নানা আনুসঙ্গিকতা, আয়োজন। অধিকিন্তু সেসবের ইন্ধনে যেন গণমাধ্যম কাঠামো শক্তিশালী, মর্যাদাশীল এবং প্রাতিষ্ঠানিক মানের বিপরীতে ক্রমান্বয়ে একটি ক্ষয়মান, বিপন্ন কাঠামো কিংবা যেমন খুশি তেমন সাজার ন্যায় হয়ে চলছে।
এখানে গণমাধ্যম নামক প্রতিষ্ঠান খুলতে কিংবা নিবন্ধন নিতে কোন নিয়মনীতি পরিশীলনের যেন প্রয়োজন নেই। ঠিক কর্মী হতেও নেই এমন কোন আয়োজন।
১৯৯০ সালের পর একটি অবাধ গণমাধ্যম কাঠামোর নামে এখন প্রায় উপজেলা, জেলা থেকেও অহরহ গণমাধ্যম অনুমোদিত হয়। আবার জাতীয় পর্যায়েও।
বলা চলে, ১৮ কোটি মানুষের দেশে গণমাধ্যম পাঠক, গ্রাহক কিংবা শুভান্যুধ্যায়ী সৃষ্টি হোক বা না হোক গণমাধ্যমের জন্ম নিতে কোন কার্পণ্য নেই। অনেকে রসিকতা করে বলেন, এখন ঘরে ঘরে পত্রিকা, সাংবাদিক। নয়তো অনলাইম নতুবা টিভি চ্যানেলও।
জানান রয়েছে, একজন নাইমুল ইসলাম ঢাকা থেকে ৪টি অনুমোদনের পর সর্বশেষ কুমিল্লা থেকেও অনুমোদন নিতে বিবেকে বাধেননি তাঁর। অথচ আমাদের সম্পাদনা, সাংবাদিকতার অঙ্গসৌষ্ঠবের ইতিবৃত্ত মোটেই সুখকর নয়।
—————————————————–
মতামত
—————————————————-
উপজেলা, জেলা পেরিয়ে ঢাকায়ও এমন অনেক গণমাধ্যম রয়েছে যাদের কোন দপ্তর নেই। কর্মী নেই। অন্যের কম্পিউটার দোকানে বসে গিজগিজ করে পত্রিকার সম্পাদনা করেন। নিজেই সম্পাদক, নিজেই প্রকাশক, নিজেই হিসাবরক্ষক, নিজেই সংবাদদাতা।
আমাদের এসব কথিত প্রতিষ্ঠানের আবিষ্কারকালে থানা পুলিশও কোন ধরনের তদারকি করেননা। শুধু কিছু আর্থিক সুৃবিধা পেলে শিক্ষাগত জাল, সনদকেও খাঁটি বলতে কাপর্ণ্য নেই তাদের। প্রশাসনের কথিত সুশাসনে, পরিষ্কার ছাপার অক্ষরের কাগজে রাতারাতি হয়ে যান সম্পাদক ও প্রকাশক। যেখানে রাষ্ট্রের এমন একটি স্তম্ভের জন্মকালে নুন্যতম একজন নির্বাহী ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিষ্ট্রেট দিয়েই তদন্ত প্রতিবেদন সাজানো যেতো।
অত:পর আমাদের এসব সম্পাদকের হাতের একটি সই স্বাক্ষরে পাড়া, মহল্লায় যখন-তখন যে কেহ হয়ে যান সাংবাদিক। এমনও রয়েছে নিজের নাম লিখতে পারেননা, তিনি বনে যাচ্ছেন বিশেষ প্রতিনিধি। অর্থ্যাৎ যেমন ঝি, তেমন জামাই। অথচ এটি একটি প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানের শুদ্ধাচারিতায় দেশের বিভিন্ন সরকারী, বেসরকারী বিশ^দ্যিালয়েও সাংবাদিকতা নামের শিক্ষা বিভাগ, গবেষণাগার রয়েছে।
—————————————————————————————–
এমন সম্পাদকের কাছে শিক্ষা-দীক্ষার কোন ধরনের মূল্য নেই। যে কেহ কিছু অর্থ ধরিয়ে দিলে সাংবাদিক বনে যাওয়া কোন কঠিন ব্যাপারই নয়। জানামতে, নোয়াখালীর সুবর্ণচরের একজন, জেলা শহরের একটি অনিয়মিত দৈনিকের সম্পাদকের মেয়ের জন্মদিনে একটি খাসি ছাগল পাঠিয়ে হয়েছিলেন নিজস্ব প্রতিনিধিও। এভাবে আদালত পাড়ার মোহরারসহ শত-শত বেকার যুবক নতুবা হতাশাগ্রস্ত যে কেহ, নতুবা কোন মামলাবাজও সাংবাদিক পরিচয়ে সারাদেশে দাপিয়ে বেড়ায়।
——————————————————————————————-
অথচ একটি গণমাধ্যমের পাতায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মানুষটি যেমন পাঠ করার সুযোগ থাকে, রাষ্ট্রের যে মানুষটি অক্ষর মিলিয়ে মিলিয়ে পড়তে পারেন ; তার হাতেও যায়। সে কারণে সর্বোচ্চ মানুষটি একটি সংবাদপত্রের খবরাখবর রচনা, বর্ণনা, সম্পাদনার ওপর যখন বিরাগভাজন হয়, তখনই সে গণমাধ্যম কাঠামোটিও দুর্বল হিসেবেই চিহ্নিত হয়। এ কারণে সাংবাদিক হওয়ার আগে শিক্ষাগত যোগ্যতার সীমাবদ্ধতা নসিহত, নিয়মসূচিতে অর্ন্তভুক্তিকরণ খুবই জরুরী ও প্রাসঙ্গিক।
একইভাবে একজন সম্পাদক হওয়ার আগে উচ্চ শিক্ষায় সম্ভ্রব থাকলে কোন গণমাধ্যমের পাঠক, গ্রাহক ওই গণমাধ্যম নিয়ে বিরুপ ধারণা পোষণ করার সক্ষমতারও সুযোগ নেই।
এ কারণে রাষ্ট্রকে একটি গণমাধ্যমকে একটি তথ্যনির্ভর প্রতিষ্ঠানে রুপায়নে অবদান রাখা জরুরী।
আমরা অনলাইনের বদৌলতে বর্তমানে যেখানে বিশ^সাংবাদিকতার যুগে প্রবেশ করেছি। সে যুগে গণমাধ্যমকর্মী নির্বাচনে দেউলিয়াপনার পরিচয় দিলে বর্হিবিশে^ আমাদের গণমাধ্যম নিয়ে নিশ্চয় ভাল ধারণার জন্ম দেয়না। রাষ্ট্রকে একটি যাচাই বাচাইয়ের মধ্য দিয়ে কোন গণমাধ্যমের অনুমোদন দিলে এটি অবশ্যই নান্দনিকতায় সাধুবাদে ধন্য হওয়ারই কথা।
তাই আমাদের সাংবাদিক হওয়ার আগেই বাধ্যবাধকতায় থাকা শিক্ষাগত যোগ্যতার মানদন্ডসহ পিআইবি হতে তথ্য মন্ত্রনালয়ের ব্যবস্থাপনায় একটি প্রশিক্ষণ সনদ নিয়ে এ পেশায় হাজির হলে নিশ্চয় তা একটি জনবান্ধব, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধ ও জবাবদিহিতায় অনেক বেশি সম্মানিত ও প্রশংসিত না হয়ে পারেনা। যে কাজটি প্রতিটি জেলার তথ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমেও করা গেলে গণমাধ্যম কাঠামো আরো সুসংসহত, শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য হতে পারে বলে আমাদের বিশ^াস।
পরিশেষে আমরা এমন একটি গণমাধ্যম জগতে বাস করতে চাই, যেখানে এটি মানের পরিমন্ডলে নির্ণিত হবে একটি সম্মানিত ও গৌরবোজ্জল পেশা। যাতে নিশ্চিত থাকবে একটি পেশাদারিত্ব সংরক্ষণের কাঠামো। একটি নির্ভরযোগ্য আইন। তবেই ভেস্তে যাবে খবর নামের গুজবের ঢালপালাও।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক দিশারী।
Leave a Reply