আকাশ মো. জসিম।সম্পাদক ও প্রকাশক
——————————————————————————————————————————————————————————————
ছাত্রজীবনের কোন এক ফাঁকে খবরের জগতের নেশা পেয়ে বসেছিল, অনেকটা উদাসিন মনে জানাটাও ছিলনা। হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের ছাত্রাবস্থায় দৈনিক কর্ণফুলিতে পাঠক কলামে ” মুসলিম ছাত্রাবাসের দুরাবস্থা ” শিরোনামে লেখাটা প্রকাশিত হওয়ার পরই খবরের সমাজের নেশায় ব্যতিব্যস্ত হই। যা ঠিক হয়নি আমার জন্যে। এরপর এ সমাজে এসেও রন্ধ্রে-রন্ধ্রে পরষ্পরিক ঘাত, প্রতিঘাত মোকাবেলা করে চলাটা অনেক বেশি বেদনাদায়ক। কণ্টকাকীর্ণ পথ। এখানে মেধাস্বত্বের প্রতিযোগিতার চেয়ে হিংসা, আত্মকলোহ, গীবতের স্বভাবটা প্রায়জনের চরিত্রের অঙ্গ যেন! মাঝেমধ্যে বিব্রত হই। ভাবি পেশাটা ছেড়ে দেবো। আবার ভাবি এ বয়সে, কি কবরো ! জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়টা তো এখানে খোয়াইছি।
——————————————————————————————————————————————————————————————
বাল্যকাল থেকেই কোন ধরনের পরাধীনতা ভাল লাগতোনা। সে অবস্থা এখনও যেন ধরে রেখেছি। প্রাথমিক থেকে দশম পর্যন্ত শ্রেণীকক্ষে ফাস্টবয় ছিলাম। ১৯৯৩ সালে নোয়াখালী শহরের হরিনারায়ণপুর উচ্চ বিদ্যালয় হতে স্টার মার্কস নিয়ে মাধ্যমিক শ্রেণী পাশ করি। সে সময়ে স্বপ্ন ছিল একজন বিজ্ঞ আইনজীবি হওয়ার। কিছুদিন ঢাকার কতেক গণমাধ্যমে প্রতিনিধি পদে কাজ করেছি। একপর্যায়ে মনে হলো, তাঁদের নানানসব খবরদারির দায়িত্ব পালন আমাকে দিয়ে হবেনা। সে কারণে সেসব রীতি-রেওয়াজ থেকে নিজেকে প্রায় গুটিয়ে নিয়েছি। এ সময়ে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আল্লাহর রহমতে অনেক সুস্থ্য, সবল ও সবাক আছি।
হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর ছাত্রত্বকালেই চট্রগ্রামের দৈনিক কর্ণফুলির মধ্য দিয়ে সংবাদপত্রের নেশায় জড়িয়ে পড়ি। একটা সময় মাঝে মধ্যে মনে হয়, এমন নেশাকে পেশা হিসেবে সঙ্গ করাটাই ছিল যেন আমার বড় ভুল।
১৯৯৭ সালে স্মাতক শেষে নোয়াখালীর দৈনিক জাতীয় নিশানের নিজস্ব প্রতিনিধি পরে সাপ্তাহিক ফয়সালা ও সাপ্তাহিক আজকের উপমার বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগদানের মধ্যে দিয়ে নিজেকে ছাত্রজীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে পুরোপুরিই বিচ্ছিন্ন করে নিই। ১৯৯৯ সালে নোয়াখালী আইন কলেজে ভর্ত্তি হয়েও আর পড়া হয়নি আইন।
একপর্যায়ে আমার ইচ্ছা ছিল, একজন আপাদমস্তক সংবাদকর্মী হওয়ার।একজন সম্পাদক হওয়ার। কিন্তু আজকের দিনে এসে আমি কিছু হতে পেরেছি কিনা জানি না। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি কিছুই করতে পারিনি, হতে পারিনি। এই হিংস্রদানা বাধা, রুদ্রপীড়িত শহরে মাঝে মধ্যে আমার মনে হয়, আমার চেয়ে স্বল্প যোগ্যতার সাংবাদিক খুব কমই আছে।
তবে আমার কাছে একটা জিনিস আছে, সেটা হচ্ছে দৃঢ়তা। আমি দৃঢ়তার পরাকাষ্টা একদিনের জন্যও ভাঙিনি। কোন স্বার্থের মোহে আমার ভালবাসার রঙ বদলায়না একক্ষণেও। আমার একটা কঠিন নিয়তিও আছে। আমি যার উপকার করি, সেই সর্বপ্রথম পরম ক্ষতিসাধনের গল্পে জড়িয়ে থাকে আমার জীবনে।
জানা স্বত্বে, আমার শরীরে আমি কোন হারাম পয়সা ঢুকানোর চেষ্টা করিনি। আমি পরিশ্রম করেছি। কারো কোন স্বত্বের বিনিময়ে নিজের ক্ষুদ্র গন্ডির পরিধিতে সভ্যতার পরিচয় রাখতে চেষ্টা করছি। পরিশ্রম আর সভ্যতার জায়গা থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টাও পত্রিকা প্রকাশনার কাজ করেছি এমন দিনও গেছে। যে কারণে হয়তো আমার প্রিয় দৈনিক দিশারী কিছুটা হলেও পরিচয়ের জায়গায় এসেছে।
———————————————————————————————————————————————————————-
এটা একটা ট্র্যাজিক গল্প হতে পারে। পত্রিকার জন্য মানুষ এত ত্যাগ স্বীকার করে কিনা আমার জানা নেই। হয়তো করে, কিন্তু তাদের বৈষয়িক ফিডব্যাক, আউটপুট বেশি আছে। আমি কষ্ট করেছি প্রচুর। কারণ, আমি বাঁকা পথ চিনতাম না। এখনওনা। এখনো অনেক সংবাদকর্মী আমাকে দিয়ে নিজের রুটি-রুজি যোগান দেয়ার অসংখ্য সত্যতা রয়েছে আমার কাছে। আমার ভাবনা আমাকে দিয়ে কেহ সামান্যটুকুও উপকৃত হলে আমার সমস্যা কোথায় ! আমি কোনকালেই বৈষয়িক ছিলাম না। যে কারণে আমার অর্থনৈতিক আউটপুট তেমন আসেনি।
তবুও আজকের দিনে এসে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। পত্রিকা ছাড়া আমি কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য তৈরি করতে পারিনি। আমার কাছে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। শুধু পত্রিকার ওপর নির্ভর করে আমি চলি। একটা পত্রিকা তৈরি করা, উদ্যোক্তা হওয়া, সেই পত্রিকায় কিছু মানুষ কাজ করবে, সেই পত্রিকার নামডাক হবে, এটাই এখন আমার লক্ষ্য।
–——————————————————————————————————————————————————————–
পথচলার ১৯ বছরে আমার প্রিয় দৈনিক দিশারী। ১৯৯৩ সালে সাপ্তাহিক হিসেবে অনুমোদন নেয়া পত্রিকাটি সময় ও পাঠক-ইচ্ছের অংশ হিসেবে ২০০৪ সালে আমার সম্পাদনায় ও শ্রদ্ধেয় এডভোকেট জামাল উদ্দিন ভূঁঞার প্রকাশনায় দৈনিক হিসেবে যাত্রারম্ভ করে।
২০০৬ সালে আমার পরিকল্পনা ও সম্পাদনায় এবং এডভোকেট জামাল উদ্দিন ভূঁঞার প্রকাশনায় সাপ্তাহিক নয়াপৃথিবী’র আত্মপ্রকাশ হয়। পরে ২০০৯ সালে এডভোকেট জামাল উদ্দিন ভূঁঞাকে অনুরোধ করে এ পত্রিকাটি অন্যত্র হস্তান্তর করি।
দীর্ঘ পথপরিক্রমায় অব্যাহত পাঠকচাহিদা পূরণ আর যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে ২০২১ সালে অনলাইন সংস্করণ চালু করে দৈনিক দিশারী। ২০২২ সালে কতেক সুহৃদজনের বিশুদ্ধ পরামর্শ ও আন্তরিক সহযোগিতায় নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের নতুন নিবন্ধনে প্রকাশক হিসেবে আমার মর্যাদা অর্ন্তভুক্ত হয়।
পূর্ণাঙ্গ পেশাদার ওয়েবের পাশাপাশি নিয়মিত মূদ্রণাকারে চেষ্টার মাধ্যমে পাঠকের ভালোবাসাকে সঙ্গী করে দৈনিক দিশারী এখন কিছুটা হলেও পরিণত, পরিব্যাপ্ত। নিরন্তর পাঠক-চাহিদা মাথায় রেখে অচিরেই দৈনিক দিশারীর নিয়মিত মুদ্রণ ও অনলাইন সংস্করণের চিন্তাও করছি আমরা।
দৈনিক দিশারীর এই দীর্ঘ সময়ের পথচলা মসৃণ ছিল না ; নানা সংকটের খানাখন্দ, বিপর্যয়ের ভাঙা সেতু অতিক্রম করতে হয়েছে।এখনো। আর্থিক চরম সংকটকাপন্ন অবস্থায়ও আমি দৈনিকটির সম্পাদনার কাজ অব্যাহত রাখার চেষ্টায় নিজেকে প্রাণবন্ত রেখেছি। নিজেই প্রতিবেদন লিখছি। কম্পিউটারের পর্দায় চোখ রাখতে রাখতে এখন চোখেও চশমা ছাড়া দেখা সহজ হয়না।
শাররিক ক্লেশ দম্যতায় আমার এখন অনেক কষ্ট হয়। তবুও দৈনিক দিশারীকে ভালোবাসি বলেই আল্লাহর অশেষ রহমতে কাজ করতে পারছি। কাজ না করে আর কী করবো ? দৈনিক দিশারী ছাড়া তো আমার আর কিছুই নেই। এটাই আমার ধ্যানজ্ঞান। দৈনিক দিশারী ঘিরেই আমার যত স্বপ্ন।দৈনিক দিশারীই আমার একমাত্র আত্মবিশ্বাস, প্রাণশক্তি আর উদ্যম।
একাধারে সংবাদ সংগ্রহ, সংবাদ নির্মাণ, বিদগ্ধজনদের লেখা সংগ্রহ, নিজেই টাইপ করা, প্রুফ দেখা, সংবাদ সম্পাদনা, নিজেই আবার পেইজ মেকিং (পৃষ্ঠা সজ্জা), প্লেট মেকারের কাছে নিয়ে যাওয়া, প্লেটের পর কাগজসহ প্রেসে পৌঁছে দেয়া। এক সময় ছাপার পর ছদ্মবেশে সেই পত্রিকা আবার পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেয়ার কাজটিও করতাম আমি। কলুর বলদের মতো এত খাটাখাটুনি একাই করতাম। হালে এ থেকেও কিছুটা নিষ্কৃতি নিতে পারছি।
পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনার নেশায় হয়তো এমন পাগল ছিলাম। বিজ্ঞাপনের চাইতে দৈনিক দিশারীর জন্য ভালো একটা লেখা সংগ্রহে গুরুত্ব বেশি দিতাম। শিক্ষক, লেখক, সাহিত্যিক ও প্রবীণ সাংবাদিকদের লেখা সংগ্রহের আগ্রহ রাখতাম। বিজ্ঞাপনের জন্য এতটা ঘুরতাম না। এখনও না। কোনমতে খরচটা ওঠলেই হলো। খেয়ে না খেয়ে নিজেই সব দায়িত্ব পালন করেছি।
দৈনিক দিশারী নিয়ে আমার স্বপ্ন ছিল, এজন্য এসব কাজকে পীড়ন হিসেবে নিইনি, আনন্দ হিসেবে নিয়েছি।
শুধু নোয়াখালী নয়, বাংলাদেশে এমন কোনো উদাহরণ আছে কিনা আমার জানা নেই, একজন ব্যক্তিই একাই একটি পত্রিকা বের করে ফেলছেন। একবার চৌমুহনীর কল্পনা অফসেট প্রেসে পেস্টিং করতে গিয়ে ধারালো ব্লেডের সাথে ডান হাতের আঙ্গুল কেটে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সে রক্ত টেসিংয়ে লেগে পত্রিকার কাগজেও মূদ্রিত হয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পত্রিকা বের হবে না এ কারণে অনেক বিনিদ্র রাতও গেছে।
জাতীয় দৈনিক ডেসটিনি, দৈনিক বাংলাদেশ সময়, দৈনিক আলোকিত সময়, দৈনিক শেয়ার বিজ, দৈনিক জাগরণ, প্রাইম খবরসহ কতেক গণমাধ্যমে কাজ করেছি। ডেইলী সানে কাজ করছি। কিন্তু দৈনিক দিশারীকে আমি ছাড়িনি, সন্তানের মতো আগলে রেখেছি।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কর্মস্থলের কাজ শেষ করে, অন্যান্য সংবাদকর্মীরা, বন্ধু-স্বজনরা যখন আড্ডায় মেতে ওঠতো, তখন সে সময়টাও আমি পত্রিকার পাতা ভরাটের জন্য কম্পিউটারে নিমগ্ন রয়েছি। পত্রিকাটা একটা জায়গায় টেনে আনার চেষ্টায় অবিরত রয়েছি ; চেষ্টার কমতি থাকবেনা আমৃত্যূ আমার। আমার বিশ্বাস, পরম করুনাময় থাকছেন নিশ্চয় সহায়।
Leave a Reply